নো এন্ট্রি' বা 'প্রবেশ নিষেধ' কথাগুলোর সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু অভিশাপ কিংবা ভুতুড়ে কর্মকাণ্ডের জন্য যদি কোনো স্থানের সামনে এমন সাইনবোর্ড ঝুলিযে দেওয়া হয়, তাহলে কেমন লাগার কথা? অবশ্যই ভীতিকর এবং বিস্ময়কর একটি বিষয়। এমনই একটি ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ জায়গা ভারতের ভানগড় দুর্গ। অভিশাপ, ভূতদের উৎপাতের কারণে জায়গাটি এত বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছে যে, সরকারিভাবেই রাতের অাঁধারে এখানে প্রবেশের ওপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
ভানগড় দুর্গটি অবস্থিত ভারতের রাজস্থানের আলোয়ার জেলায় জয়পুর আর দিলি্লর মাঝামাঝিতে। ভয়ঙ্কর ইমেজের কারণে সন্ধ্যা নামার আগেই ভানগড় থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে সরে যাওয়া নিরাপদ মনে করে এলাকার লোকজন। তাদের বিশ্বাস, এখানে থাকলে অস্বাভাবিক কিছু ঘটবেই। এখানে থাকলে মানুষের মনের অস্থিরতা বেড়ে যায়। আর মনের মধ্যে ভর করে অজানা-অচেনা আতঙ্ক কিংবা ভয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে স্থানীয় লোকজন দুর্গের আশপাশের এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে পারে না। আবার সাহস করে কেউ যদি বাড়ি নির্মাণও করে ফেলে, তাহলে সেই বাড়ির ছাদ রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো কেউ যদি ছাদ নির্মাণও করে, তাহলে সেটি আপনা-আপনি ধসে যায়।
ভানগড় দুর্গের প্রকৃত ইতিহাস আজও অজানা। তবে এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ধারণার প্রচলন রয়েছে। এর মধ্যে একটি অনুসারে সতেরো শতকে রাজা মান সিংয়ের ছোট ভাই মাধো সিং এই দুর্গের নির্মাতা। মোগল শাসনের প্রতাপ-প্রতিপত্তি কমার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্গটির দুর্দশা শুরু হয়। নগরীর শুরুর দিকে ভানগড়ের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। সীমানাপ্রাচীরের মাঝে মাঝে ৫টি তোরণ তৈরি করে শহরটিকে আশপাশের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভানগড় দুর্গ নগরীর ধ্বংস স্তূপের মধ্যে এখনো টিকে আছে মসজিদ আর মন্দির। টিকে আছে হুনুমান, শিব, নারায়ণ এবং গোপীনাথের মন্দির।
এই নগরকে অভিশপ্ত মনে করার পেছনে ইতিহাসের বেশ কয়টি শক্ত কারণ রয়েছে। ভানগড়ের সঙ্গেই ছিল গুরু বালুনাথের আশ্রম। গুরু বালুনাথ রাজা ভানু সিংকে নগর তৈরি করার সময় বলেছিলেন যেন তাকে বিরক্ত না করা হয়। এ বিষয়ে গুরুরাজাকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। একবার সতর্কবার্তা পাঠান গুরু। আর সেই বার্তাটি ছিল, প্রাসাদের ছায়া তার আশ্রম ছোঁয়া মাত্রই শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু রাজা ভানু সিং বালুনাথের কথা মানেননি। পরবর্তী সময়ে গুরু বালুনাথের কথাই সত্যি হয়। প্রাসাদের উচ্চতার কারণে ছায়া পড়ে তার আশ্রমে। এর পরই ধ্বংস হয়ে যায় এ শহর। প্রচলিত বিশ্বাসের সেই গুরু বালুনাথের সমাধিও রয়েছে ভানগড়ে। নগরী ধ্বংসের পেছনে আরও একটি কারণ প্রচলিত রয়েছে। ভানগড়ের রাজকুমারী রত্নাবতী বয়োপ্রাপ্ত হলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। সে সময় ভানগড় এলাকায় সিংহিয়া নামে এক তান্ত্রিক বাস করত। সিংহিয়া রাজকুমারী রত্নাবতীকে ভালোবাসত। কিন্তু তান্ত্রিক সিংহিয়া তন্ত্রবলে জানতে পেরেছিলেন রত্নাবতী তার প্রেমে সাড়া দেবে না। এর পরও দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না সিংহিয়া। তিনি সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। একদিন রাজকুমারী সহচারীদের সঙ্গে নিয়ে কাছের বাজারে পছন্দের সুগন্ধি তেল কেনার জন্য আসেন। সুযোগটা ব্যবহার করে তান্ত্রিক সুগন্ধির ওপর জাদুর প্রভাব বিস্তার করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল এই সুগন্ধির প্রভাবে রাজকুমারীকে নিজের বশে নিয়ে আসা। কিন্তু রাজকুমারী ছিলেন দারুণ বুদ্ধিমতী। তিনি তান্ত্রিকের কুমতলব অাঁচ করতে পারলেন। বুঝতে পেরে রাজকুমারী বাজার থেকে কেনা সুগন্ধি তেল মাটিতে ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রাজকুমারীর ফেলে দেওয়া তেল থেকে তৈরি হয় বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড। অগ্নিকুণ্ডের লকলকে জিব তাড়া করে জাদুকরকে। আগ্নেয়লাভা জাদুকরকে দ্রুত ধরে ফেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। তান্ত্রিক মারা যাওয়ার আগে ভানগড় নগরী ধ্বংসের অভিশাপ দিয়ে যায়। পরের বছর এক যুদ্ধে প্রাণ হারান রাজকুমারী। যুদ্ধের ক্ষতে ধ্বংস হয়ে যায় নগরী। এরপর থেকে এ নগরী অভিশপ্ত নগরী হিসেবে পরিচিতি পায় ভারতজুড়ে। ভানগড় নগরীকে কেন্দ্র করে এমন উপকথা আর এই সময়ে মানুষের ভয়ের গল্প শুনলে যে কারোর কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হওয়ার কথা। মনের ভেতর প্রশ্ন আসবে সত্যি আবার এমন হতে পারে নাকি। কিন্তু ভারতজুড়ে তো বটেই, বিশ্বজুড়েও ভানগড়ের অদ্ভুতুড়ে কীর্তিকলাপ ফলাও করে প্রচার হয়েছে। শুধু কী তাই? অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ভানগড় নগরের সামনে ভারতের প্রত্নতাত্তি্বক দফতর একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে। যাতে লেখা আছে, 'ভানগড় এলাকায় সূর্যাস্তের পরে এবং সূর্যোদয়ের আগে প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ।'
No comments:
Post a Comment