প্রকৃতির
সহাবস্থানের দেশ পেরু
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী এ দেশটির
ভূপ্রকৃতিতে চরম বৈপরীত্যের
সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়। এখানে আছে জনবিরল মরুভূমি, বরফাবৃত পর্বতমালা, উচ্চ মালভূমি আর গভীর উপত্যকা। আন্দিজ পর্বতমালা পেরিয়ে দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে ঘন ক্রান্তীয় অরণ্য। জনবসতি তেমন ঘন নয়। প্রশান্ত মাহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত লিমা দেশটির প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও রাজধানী। ১৫৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি স্পেনিশ নাগরিক ফ্রান্সিসকো পিজারো লিমা আবিষ্কার করেন। এর আগে দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তৃত ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পেরু। ১৬শ শতকে স্পেনের বিজেতাদের হাতে ইনকা
সাম্রাজ্যের
পতন ঘটে। আন্দিজের স্বর্ণ ও রুপার খনির আকর্ষণে
স্প্যানিশরা খুব শীঘ্রই পেরুকে
দক্ষিণ আমেরিকাতে তাদের সম্পদ ও শক্তির কেন্দ্রে রূপান্তরিত করে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে দেশটি স্প্যানিশ
উপনিবেশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করে। পেরুর
মোট আয়তন ১২ লাখ ৮৫ হাজার ২১৬ বর্গকিলোমিটার।
পেরুর নাজকা মরুভূমিতে যদি
একটি বিমান নিয়ে উড়ে যাওয়া যায়, তাহলে অপেক্ষা করবে এক অপার বিস্ময়। ককপিট থেকে দেখা যাবে মরুভূমির বুকে আঁকা অসংখ্য আঁকিবুঁকি, জ্যামিতিক নকশা আর পশু-পাখির ডিজাইন। রাজধানী লিমা থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাজকা এবং পালমা শহরের মাঝামাঝি স্থানে
প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ অসাধারণ
শিল্পকর্ম। এখানে
আঁকা চিহ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে জ্যামিতিক নকশা, হামিংবার্ড, মাকড়সা, হাঙ্গর
আর নানা সরীসৃপের রেখাচিত্র। চিত্রগুলো বিমান থেকে বা স্যাটেলাইটে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। প্রায় ১৮০টির মতো নকশা রয়েছে এখানে। শ’খানেক জ্যামিতিক চিত্র বাদে বাকিগুলো পশু-পাখিদের প্রতিলিপি। ১৯৩০-এর দশকে সর্বপ্রথম বিমানযোগে ওই মরুভূমি পার হওয়ার সময় এ লাইনগুলো আবিষ্কৃত হয়। এরপর থেকে এ নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার শেষ নেই। গবেষকদের ধারণা, নাজকা সম্প্রদায়ের লোকেরা কাঠ ও কাঠজাতীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে এ রেখাগুলো এঁকেছে। অনেকগুলো রেখার শেষপ্রান্তে কিছু কাঠের উপকরণ পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে কার্বন টেস্টের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ওই রেখা অঙ্কনের সময়কাল বের করেছেন। তবে এ রেখাগুলো কী কারণে আঁকা হয়েছিল, তা নিয়ে গবেষণা শেষ হয়নি। বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ এরিক ফন দানিকেনের মতে, নাজকা লাইনগুলো মূলত আগন্তুকদের ব্যবহার করা এয়ারস্পেস ও সিগন্যাল সেন্টার হিসেবে কাজ করত। আগন্তুকদের তখনকার মানুষেরা স্বর্গ থেকে নেমে আসা
দেবদূত ভেবেছিল এবং দেবতা হিসেবে তাদের পূজা করেছিল। তবে বেশির ভাগ গবেষকই এ মতের সঙ্গে ভিন্নতা প্রকাশ করেন। অনেকে মনে করেন, স্থানীয়রা তাদের উপাস্য দেবতাদের খুশি করার জন্য এ ধরনের বিশালাকৃতির রেখাচিত্র এঁকেছিল, যাতে দেবতারা স্বর্গ থেকেও তা দেখতে পান। আবার কেউ কেউ মনে করেন, জ্যোতির্বিদ্যা ও নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের কাজে এ রেখাগুলো আঁকা হয়েছিল। মানব সভ্যতার বিকাশে এ এক অসামান্য উপাদান। কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি ছাড়া শুধুমাত্র মানবিক প্রচেষ্টায় তৈরি এমন নান্দনিক
নকশা সত্যিই অসাধারণ। প্রশ্ন হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব যুগের এই অগভীর পাতলা রেখাগুলো এ কয়েক
হাজার বছর পরেও কিভাবে এত নিখুঁত আর অক্ষত আছে? এর উত্তর পেরুর ওই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির মাঝেই লুকিয়ে আছে। নাজকা মরুভূমি বৃষ্টিশূন্য একটি এলাকা, বায়ুপ্রবাহও খুব কম। সারা বছরই সেখানকার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি
সেলসিয়াসের আশপাশে থাকে। এ কারণেই হয়তো আজও অক্ষত থেকে আমাদের বিস্ময়ের
জোগান দিয়ে চলেছে এই নাজকা লাইনস। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব
পড়েছে সেখানেও। ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ব্যাপক বন্যা আর ভূমিধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই অঞ্চলটি। ইউনেস্কো ১৯৯৪ সালে পেরুর এই নাজকা লাইনসকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। সারা বিশ্বের অসংখ্য পর্যটক আজও আসেন এ বিস্ময়কীর্তি দেখার জন্য। কৃষি ও পর্যটন পেরুর অর্থনীতির বড় জোগানদাতা। ইনকা সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ, বিশেষ করে মাচু পিচু শহর দেখতে এখানে বেড়াতে আসেন বহু পর্যটক। আন্দিজ পর্বতমালার পেরুর অংশে একটি পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত ইনকাদের হারানো শহর মাচু পিচু। এখন অবশ্য পুরো পাহাড়টির নামই হয়ে গেছে মাচু পিচু। সুরক্ষিত শহরটি পর্বতের চূড়া থেকে একেবারে
খাড়াভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর পাদদেশে গিয়ে
মিশেছে। অন্যদিকে
হুয়ানা পিচু
নামের আরেকটি পর্বত খাড়া
উঠে গেছে আরও কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে। দুই দিক দিয়েই
নিরাপদ শহরটিকে ইনকাদের প্রাচীন দুর্গনগরী নামেও ডাকা হয়।
|
No comments:
Post a Comment