পিসি রায়
বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল চন্দ্র রায় (পিসি রায়) শুধু তার জন্মভূমি দক্ষিণ খুলনার অবহেলিত জনপদ পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামই ধন্য হয়নি বরং ভারতবর্ষের মানুষ তার জন্ম গৌরবে গৌরবান্বিত। অথচ পিসি রায়ের জন্মভিটার স্মৃতিচিহ্নগুলো অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। খসে পড়ছে ভবনের পলেস্তারা। মূল্যবান গুপ্তধনসহ স্মৃতিচিহ্নগুলো চুরি হয়ে গেছে। শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মামলা হয়েছে কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে রাড়ুলী গ্রামে জমিদার রায় পরিবারে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট বাংলা ১২৬৮ সালের ১৮ শ্রাবণ পিসি রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হরিশচন্দ্র রায় ও মাতার নাম ভুবন মোহিনী রায়। তিনি ১৮৭২ সালে প্রথম কলকাতার হেয়ার স্কুলে ও পরবর্তীতে ১৮৭৬ সালে আলবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৭৮ সাল তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৮৮০ সালে মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৮৮১ সালে এফএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ ভর্তি হন। ১৮৮২ সালে তিনি এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিলক্রেস্ট বৃত্তি পেয়ে সেপ্টেম্বর মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় যান। ১৮৮৭ সালে অন প্রিরিয়াডিক ক্লাসিফিকেশন অব এলিমেন্টসের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি 'মার্কিউরাস নাইট্রাইট' আবিষ্কার করে বাঙালির জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেন। এর ওপর ১২টি যৌগিক লবণ, ৫টি থায়োস্টার ও ১৪৫টি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন। ১৮৯২ সালে কলকাতার মানিকতলায় বেঙ্গল কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কার্স লি. নামে ওষুধ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একাধারে ২৭ বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেন। বিজ্ঞানচর্চায় পারদও আবিষ্কার করেন।
সর্বশেষ জানা গেছে মৃত্যুর ৬৮ বছর পর ২০১২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রসায়ন গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি (আরএসসি) একমাত্র বাঙালি বিজ্ঞানী পিসি রায়কে 'কেমিক্যাল ল্যান্ডমার্ক পাক' উপাধি দিয়ে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।
পিসি রায় একাধারে একজন রসায়ন শাস্ত্রের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিক্ষানুরাগী, শিল্পপতি, শিল্পী, সমবায় আন্দোলনের পুরোধা এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। পিসি রায় খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কাপড়ের মিল প্রতিষ্ঠা করেন। চিরকুমার এই বিজ্ঞানী তার জীবনে অর্জিত সব সম্পদ মানব কল্যাণে দান করে গেছেন।
অথচ বিশ্ববরেণ্য এই বিজ্ঞানীর বসতভিটা অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। প্রতি বছর তার জন্মবার্ষিকী পালনের সময় আয়োজক কমিটি ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিজ্ঞানীর বসতভিটা সংস্কার এবং পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু আজো তার বাস্তবায়ন হয়নি।
সম্প্রতি পিসি রায়ের বসতভিটার শতবর্ষের পুরনো মূল্যবান গাছ কাটার অভিযোগ উঠে খোদ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পত্রিকায় কেটে ফেলা গাছের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যার সুরাহা আজো হয়নি।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রচার সংঘের সভাপতি ও স্মৃতি রক্ষা আন্দোলনের নেতা সহচরী বিদ্যামন্দির স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক হরে কৃষ্ণ দাশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পিসি রায়ের বসতভিটা স্মৃতিচিহ্নগুলো যথাযথ ব্যবস্থাপনায় নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কারণ দেশ-বিদেশ থেকে বিভিন্ন সময় আসা পর্যবেক্ষকদের কাছে জরাজীর্ণ বসতভিটার চিত্রটি দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে কিছু সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে কিন্তু তা প্রত্যাশিত নয়। এখনো অনেক মূল্যবান সম্পদ রয়েছে যা যথাযথভাবে সংরক্ষণ হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment